তসলিমা নাসরিন :আফতাব পুণাওয়ালা নামের এক লোক তার প্রেমিকা শ্রদ্ধা ওয়াকারকে শ্বাসরোধ করে মেরে করাত দিয়ে শরীরকে ৩৫ টুকরো করে কেটে, কিছুকাল ফ্রিজারে রেখে, এক সময় টুকরোগুলোকে কিছু কিছু করে ব্যাগে ভরে বিভিন্ন ঝাড়জঙ্গলে ফেলে দিয়েছে। এটি ছ’ মাস আগের ঘটনা। পুলিশ কিছুদিন আগে আফতাবকে গ্রেফতার করেছে, কারণ শ্রদ্ধার বাবা কয়েক মাস সোশ্যাল মিডিয়ায় মেয়ের অনুপস্থিতি দেখে মেয়ের খোঁজ পেতে এফআইআর করেছে। পুলিশ আফতাবকে রিমান্ডে রেখে শ্রদ্ধা কোথায় আছে তা জানতে গিয়েই জেনেছে তাকে মেরে ফেলেছে সে। আফতাব এবং শ্রদ্ধা গত তিন বছর একত্রবাস করছিল। মুম্বইতেই তাদের পরিচয় ডেটিং অ্যাপের মাধ্যমে। কেউ কেউ বলছে, আফতাব হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়েছে, শেফ হিসেবেও নাকি কোথাও কাজ করেছে, হাড়মাংস কাটার শিক্ষা সেখান থেকেই সে পেয়েছে। আফতাব আর শ্রদ্ধা দুজনই মুম্বইতেই বাস করতো, কল সেন্টারে চাকরি করতো, পরিবার থেকে তাদের সম্পর্কে আপত্তি করায় এক সময় দুজনই মুম্বই ছেড়ে হিমাচল প্রদেশে চলে গেছে, পরে দিল্লিতে এসেছে। দক্ষিণ দিল্লিতে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থেকেছে। দুজনের তখন প্রায়ই ঝগড়া হতো। একে অপরকে অন্য কারও সঙ্গে গোপনে প্রেম করার অভিযোগ করতো। আফতাবের সঙ্গে ছিলও নাকি অন্য মেয়েদের যৌন সম্পর্ক। শ্রদ্ধা আফতাবকে চাপ দিত বিয়ে করার জন্য। আফতাব পুলিশকে বলেছে সে এই চাপ সহ্য করতে পারতো না, তার রাগ হতো খুব। একদিন তার রাগ এমন চরমে ওঠে যে সে শ্রদ্ধাকে গলাটিপে হত্যা করে। টেলিভিশনে ক্রাইম শো দেখে অভ্যস্ত আফতাব এও জানিয়েছে ক্রাইম সিরিজ ডেক্সটার দেখেই নাকি সে শিখেছে মানুষকে কীভাবে খুন করতে হয়, কীভাবে কুচি কুচি করে মৃতদেহ কাটতে হয়, কুচি কুচি করে কেটে কীভাবে ফ্রিজারে রাখতে হয়, এবং তারপর রাতের অন্ধকারে শরীরের টুকরো টুকরো হাড়গোড় মাংসপিণ্ড দূরে কোথাও ফেলে আসতে হয়।
আফতাবের এই বীভৎস নৃশংস কীর্তিকলাপ শুনে আমার মনে পড়েছে দেরাদুনের রাজেশ গুলাটিকে। ২০১০ সালে আমেরিকা-ফেরত সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার রাজেশ গুলাটি তার স্ত্রী অনুপমাকে ঠিক এভাবেই খুন করেছিল। অনুপমার পরিবার থেকে যথেষ্ট পণের টাকা তার পাওয়া হয়নি, তাই ক্ষোভ ছিল রাজেশের। রাজেশও অনুপমাকে প্রথম শ্বাসরোধ করে হত্যা করে, তারপর বাজার থেকে ইলেকট্রিক করাত কিনে নিয়ে আসে, সেই করাত দিয়ে অনুপমার শরীরকে ৭০ টুকরো করে। টুকরোগুলোকে দুই মাস ফ্রিজারে রেখে দেয়, তারপর রাতের অন্ধকারে একটু একটু করে টুকরোগুলোকে ব্যাগে ভরে দূরে কোথাও ঝাড়জঙ্গলে ফেলে দেয়। অনুপমার বাবা অনেকদিন মেয়ের খোঁজ না পেয়ে মামলা করে। সেই মামলাতে ফেঁসে যায় রাজেশ গুলাটি। অনুপমার মৃত্যু রহস্য উদ্ধার হয়। রাজেশ গুলাটি এখন জেলে।
আমি ডেক্সটার সিরিজ কোনওদিন দেখিনি। জানিওনা সেখানে কী দেখায়। তবে আমার মনে হয় রাজেশ গুলাটি যেভাবে অনুপমাকে হত্যা করেছিল, যেভাবে করাত কিনেছিল, যেভাবে অনুপমার শরীর কুচি কুচি করে কেটেছিল, যেভাবে সেসব ফ্রিজারে রেখেছিল, এবং ঝাড়জঙ্গলে ফেলেছিল, তা দেখে শিখেছে আফতাব। আফতাব পুণাওয়ালা ঠিক তাই তাই করেছে যা এগারো বছর আগে রাজেশ গুলাটি করেছিল। টুইটারে সেদিন আমার এই অনুমানের কথা জানানোর সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য মুসলিমবিদ্বেষী লোক আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দাঁতে নখে ছিঁড়তে শুরু করলো আমাকে। তাদের ভাষ্য, আফতাব মুসলিম, সে তার পবিত্র ধর্মগ্রন্থ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই প্রেমের অভিনয় করে এক অমুসলিম মেয়েকে কব্জা করেছে এবং তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। সাধারণত কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা মুসলমান যুবকদের প্রেমজিহাদ করার দোষে দোষী করে। তারা অভিযোগ করে, ‘মুসলমান যুবকেরা অমুসলমান মেয়েদের প্রেমে ফাঁসিয়ে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করে বিয়ে করে; এ প্রেম নয়, বিয়ে নয়, এ আসলে ধর্মান্তকরণের জিহাদ।’ মুসলিমবিদ্বেষীরা আফতাবের নৃশংসতার দায়ভার এককভাবে তার ধর্মের ওপর চাপাচ্ছে। অমুসলিমরাও যে একইরকম নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটায় বা ঘটাতে পারে তা মোটেও স্বীকার করতে চাইছে না। স্বীকার করতে না চাওয়াটা অবশ্য সম্পূর্ণই রাজনৈতিক। যখনই কোনও সামাজিক সমস্যাকে রাজনীতির হাতিয়ার করা হয়, তখনই আমরা লক্ষ্য করি অনেক অপ্রিয় সত্যকে কার্পেটের তলায় তড়িঘড়ি লুকিয়ে ফেলা হয়।
গত মাসেই সঞ্জয় পান্ডিতা, এক সরকারি স্কুলশিক্ষক, তার ন’ বছর বয়সী কন্যার সামনেই তার স্ত্রীকে ছুরির আঘাত করেছে। গত মাসেই কেরালাতে ঘটে গেছে নারীহত্যা। আয়ুর্বেদ মালিশ ব্যবসায়ী ভাগাবাল সিং এবং তার স্ত্রী তাদের ব্যবসার উন্নতির জন্য আক্ষরিক অর্থেই নারীবলি দিয়েছে। পদ্মা আর রোজেলিন নামের দুই নারীকে তারা হত্যা করেছে, এবং পদ্মাকে তো কেটে ৫৬ টুকরো করেছে। এ বছরের জুন মাসে উত্তর প্রদেশের ১৮ বছর বয়সী এক মেয়েকে হত্যা করে টুকরো টুকরো করে আখ ক্ষেতে ফেলে এসেছিল সন্তোষ ভার্মা নামের এক লোক। মুম্বইয়ে কয়েক বছর আগে ফরাসি নাগরিক মধুবন্তী পাঠককে তার স্বামী গিরিশ পটি হত্যা করার পর টুকরো টুকরো করে কেটে ফ্রিজারে রেখে দিয়েছিল। মধুবন্তী ফ্রান্সে ফেরত যেতে চেয়েছিল, সে কারণেই গিরিশ তাকে খুন করেছে। গিরিশের যাবজ্জীবন হয়ে গেছে। দেশজুড়ে নারী ধর্ষণ, নারী হত্যা চলছেই। হত্যা করার পর মৃত শরীর টুকরো টুকরো করে কেটে স্যুটকেসে ভরে ফেলে দেওয়া, প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে আবর্জনায় বা ঝাড়জঙ্গলে, ম্যানহোলে বা নদীর জলে ফেলে দেওয়া কোনও নতুন ঘটনা নয়। এমন ঘটনা নিরবধি ঘটেই চলেছে। এসব আমাদের আর অবাক করে না। নারীহত্যা সব দেশে, সব ধর্মে, সব সমাজে, সব জাতে, সব শ্রেণিতেই আছে। গত মাসেই বস্টন শহরে কামিল রানোসজেক নামের এক লোক তার প্রেমিকা ইলোনা গোলাবেককে মাথায় আঘাত করে হত্যা করেছে, এবং ইলোনার শরীরকে ১৫ টুকরো করে টুকরোগুলোকে বস্টন পার্কে ফেলে দিয়ে এসেছে। হত্যাকাণ্ডের সময় তাদের তিন বছর বয়সী কন্যা পাশের ঘরে ঘুমোচ্ছিল। কামিলের অভিযোগ ইলোনা ডেটিং অ্যাপ টিন্ডারে অন্য পুরুষের সঙ্গে কথা বলতো। এই হত্যার ঘটনা জানাজানি হয় হত্যার কয়েক মাস পর। কামিল রানোসজেকের এখন ২২ বছরের জেল হয়ে গেছে।
নারীকে ধর্ষণ করা আর হত্যা করা যেহেতু কঠিন কোনও কাজ নয়, তাই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এই কাজটি পুরুষেরা করে যাচ্ছে বহুকাল। নারীরা সবচেয়ে বেশি অত্যাচারিত হয় ঘরে, পরিবারের সবচেয়ে কাছের লোক দ্বারা। স্বামী বা প্রেমিকের হাত নারীর শ্বাসরোধ করার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রস্তুত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপে দেখি সারা বিশ্বে ৭৩ কোটি ৬০ লক্ষ মেয়ে অর্থাৎ প্রতি তিনজন মেয়ের মধ্যে একজন মেয়েই জীবনের কোনও না কোনও সময় শারীরিক নির্যাতন অথবা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। একটি অপ্রিয় সত্য হলো- মেয়েরা তাদের জীবনে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয় তাদের ঘনিষ্ঠ লোক অর্থাৎ স্বামী বা প্রেমিক দ্বারা। বিশ্বের ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী মেয়েদের এক তৃতীয়াংশই অর্থাৎ শতকরা ২৭ জন মেয়েই ঘনিষ্ঠ লোক দ্বারা শারীরিক নির্যাতন অথবা যৌন নির্যাতনের শিকার। যে ঘরকে মেয়েরা সবচেয়ে বেশি নিরাপদ বলে মনে করে, এবং পরিবারের যে লোকদের, বা ঘনিষ্ঠ যে লোকদের মেয়েরা সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করে, তারাই কিন্তু সবচেয়ে বেশি মেয়েদের অত্যাচার করে, নির্যাতন করে, ধর্ষণ করে এবং খুন করে।
জাতিসংঘের গবেষণায় দেখি ২০২০ সালে সারা বিশ্বে ৮১ হাজার মেয়ে খুন হয়। এই ৮১ হাজারের মধ্যে ৪৭ হাজার মেয়েকেই খুন করে পরিবারের লোক বা স্বামী/প্রেমিক। এর মানে তারা প্রতি ১১ মিনিটে একজন মেয়েকে খুন করে। ভাবলে দুঃখ হয় যে মেয়েদের ঘরই মেয়েদের জন্য সবচেয়ে অনিরাপদ স্থান। এই ঘরেই মেয়েরা সবচেয়ে বেশি যৌন নির্যাতনের এবং শারীরিক অত্যাচারের শিকার হয়। এই ঘরেই মেয়েরা সবচেয়ে বেশি খুন হয়। মেয়েদের খুন হওয়ার কারণগুলো আমরা তো সবাই জানিই। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, লিঙ্গ বৈষম্য, নারীবিদ্বেষ, নারীকে তুচ্ছ ভাবার মানসিকতা।
যতদিন না পুরুষতন্ত্র ভেঙে টুকরো হয়, নারীবিদ্বেষের অস্তিত্ব বিলীন হয়, লিঙ্গ বৈষম্য বিলুপ্ত হয়, নারীবিরোধী মানসিকতার অবসান হয়, নারীরা ধর্ষিতা হতে থাকবে, খুন হতে থাকবে, নির্যাতনের শিকার হতে থাকবে। সমাজের নিষ্ঠুরতাগুলো নিজে নিজে ভেঙে টুকরো হবে না, এদের অস্তিত্ব নিজে নিজে বিলীন হবে না; আমাদের ভাঙতে হবে সমস্ত অশুভ অপশক্তিকে, লিঙ্গবৈষম্যকে বিলুপ্ত করার দায় সমাজের, নারী-পুরুষ সকলের। মানুষ যেমন অন্ধকারে ছেয়ে ফেলতে পারে সমাজ, মানুষই অন্ধকার সরিয়ে আলো আনতে পারে। আলোকিত করতে পারে পৃথিবী। মানুষই বৈষম্য তৈরি করে, মানুষই বৈষম্যের অবসান ঘটায়।
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা। সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন